The roots of Bengali culture
বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় সংরক্ষনে : কিছু প্রস্তাব
🌑 অভিজিৎ মিত্র
Bengal Times News, 22 December 2023
বাংলা ও বাঙালি। যে সীমানা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শেকড় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পর সপ্তদশ শতকে শশাঙ্ক সিংহাসনে বসা থেকে শুরু হয়ে (৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দ যবে থেকে বঙ্গাব্দ শুরু) দ্বাদশ শতকের বাঙ্গালিয়ানার ‘স্বর্ণযুগ’ দেব সাম্রাজ্য অবধি (শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব ও ভবদেব)। পরবর্তীকালে নবাবদের শাসন হয়ে ব্রিটিশ রাজত্ব পেরিয়ে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, রবিঠাকুরের নেতৃত্বে গর্জে ওঠা ও ১৯১১-য় আবার এক হয়ে যাওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে গোটা দেশকে মশাল হাতে রাস্তা দেখানো থেকে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা অবধি। দীর্ঘ ১৪০০ বছরের ইতিহাস। যে বাংলা নেতাজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজদের কাঁপিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নবজাগরণ ও লোকসংস্কৃতিতেও এগিয়ে থেকে দেশকে রাস্তা দেখিয়েছে। সেই বাংলার সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি এই একুশ শতকে নিজস্ব গতি নিয়ে এগিয়ে চলছে ঠিকই, আস্তে আস্তে তার মুকুটে বিভিন্ন পালকও যোগ হচ্ছে, কিন্তু হঠাৎ কোথাও যেন মনে হয় তার গরিমাজনিত কিছু শূন্যস্থান রয়ে গেল। বহুত্বের সমাবেশে কিছু ফাঁক। সেই শূন্যস্থানগুলো দেখিয়ে দেবার জন্য আজ কালি কলম। গোপন বাঙালিয়ানা ইচ্ছেগুলো মনের কুঠুরীর চাবি খুলে সামনে আনব বলে মনন পেতেছি। বছরশেষের পাতাঝরা বিকেলে, হতেই পারে, আমার ভাবনা অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক – ‘আজকে দাদা যাবার আগে/ বলব যা মোর চিত্তে লাগে/ নাইবা তাহার অর্থ হোক/ নাইবা বুঝুক বেবাক লোক’। অর্থ-অনর্থ বিচারের দায়-দায়িত্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের।
দেখুন, এখন আমরা বাঙালি হিসেবে গর্ব করে আমাদের নিজস্ব বিবেকানন্দ জয়ন্তী, নেতাজী জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করি। আরেকটু এগিয়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আম্বেদকর জয়ন্তী, গান্ধী জয়ন্তী। কিন্তু শুধুমাত্র এই ক’জন মনিষীকে স্মরন করতে গিয়ে, এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকায়ত অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, আমার মনে হয়, আমরা এমন কিছু ব্যক্তিত্বকে (এবং তাদের কর্মকান্ডকে) ভুলে যাচ্ছি যাদের অবদান ছাড়া বাংলা সংস্কৃতির অনেক ক্ষেত্র ধূসর। সে ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নবজাগরণ – যে বিষয়েই হোক না কেন। উদাহরন দিই। জানুয়ারী ১ আমরা পাশ্চাত্য ভাবধারায় ‘নিউ ইয়ার্স ডে’ হিসেবে পালন করি, ছুটি কাটাই। কিন্তু বেশিরভাগ বাঙালি এই দিনটা যে ‘কল্পতরু দিবস’, সেই হিসেবে দেখেন না। অথচ ১৮৮৬ সালে ১লা জানুয়ারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মৃত্যুর কিছুমাস আগে, কি করেছিলেন কি বলেছিলেন, বাংলার নবজাগরণে তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য কোথায়, তা খোঁজার চেষ্টা করেন না। আবারো বলি, সমস্ত ধর্মের সংস্কৃতি ও সমন্বয়ের প্রতি এবং মনীষিদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অটুট থাকুক, কিন্তু সেই ভীড়ে আমরা কোথাও কোনভাবে নিজেদের ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি না তো? আর এজন্যই আমি বাংলা ও বাঙালির সেই শেকড়গুলো সংরক্ষন নিয়ে চিন্তিত। আমি চাই, ক্যালেন্ডারের আরো কয়েকটা দিন বাঙালি ঐতিহ্যের, বাঙালি গরিমার স্মরনিকা হিসেবে তুলে রাখা হোক। যদিও পাঠক, আমি একবারও বলছি না এইসমস্ত দিনগুলোয় ছুটি ঘোষনা করা হোক, কারন ছুটি ঘোষনা করলে সাধারনের মনে সেই দিনগুলোয় কেন ছুটি, তা নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে না। বরং এই দিনগুলো বাংলার জন্য কিছু ‘বিশেষ দিবস’ হিসেবে ঘোষনা করে বলা হোক, সমস্ত স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই দিনগুলোয় সেই সংক্রান্ত অনুষ্ঠান করতে হবে, যাতে জনমানসে এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে। ঠিক এই কারনেই আমি বিবেকানন্দ, নেতাজী ও রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ছুটি দেবার পক্ষপাতী নই, বরং এই দিনগুলোয় যেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এদের স্মরন করা বাধ্যতামূলক হয়। যাতে বাংলা ও বাঙালির গৌরবের শেকড় কোথায়, সেটা বোঝা যায়। আর ঐ শেকড় খোঁজার জন্যই, আমি কিছু শূন্যস্থান নিয়ে টানাটানি করতে চাই। চাই এই দিনগুলো ক্যালেন্ডারে নির্দিষ্ট ‘দিবস’ হিসেবে পালিত হোক। বরং তারিখ ধরে, কি বলতে চাই সেটা খোলসা করি।
১) পরমহংস দিবসঃ ১৮ ফেব্রুয়ারীঃ ধর্মের আঙিনায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮ ফেব্রুয়ারী ১৮৩৬ – ১৬ অগস্ট ১৮৮৬) ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম এক কান্ডারী। যিনি ‘যত্র জীব তত্র শিব’ মন্ত্রের মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন জীবে প্রেমের মধ্যে দিয়ে ভাগবত প্রেম, ‘আমার ধর্ম ঠিক আর অপরের ধর্ম ভুল, এ মত ভাল না’ বা ‘যত পথ তত মত’ -এর মধ্যে দিয়ে উদারতা, ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’র মধ্যে দিয়ে সততা ও নির্লিপ্ততা। তার সহজ দর্শন ও বাংলার গ্রামীন উপভাষায় ছোট ছোট গল্পের মধ্যে দিয়ে দেওয়া শিক্ষা সেই সময় ও পরবর্তীকালে জনমানসে বিরাট প্রভাব ফেলে। আমরা আজ যখন শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে ছুটির কথা ভাবতে পারি, তখন কি পারি না ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণর জন্য একটা দিন পরমহংস দিবস হিসেবে তুলে রাখতে?
২) চলচ্চিত্র দিবসঃ ৩০ মার্চঃ সত্যজিৎ রায় (২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২) বাঙালি সাংস্কৃতিক জগতে কে এবং কি, তা আমরা সবাই জানি। ১৯৫৫ সালে, যখন বাংলা সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে কেউ চিনত না, ওনার ‘পথের পাঁচালী’ সেই কাজ করেছিল। জীবনের শেষভাগে, উনি মারা যাবার কয়েক সপ্তাহ আগে, ১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ, ওনাকে সাম্মানিক অস্কার পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। সুদূর আমেরিকা থেকে অড্রে হেপবার্ন এসে রোগশয্যায় শায়িত সত্যজিতের হাতে সেই সন্মান তুলে দিয়েছিলেন। এই বিশেষ প্রাপ্তিকে মাথায় রেখে, আমার মনে হয়, ৩০ মার্চ দিনটা ওনার জন্য ‘চলচ্চিত্র দিবস’ হিসেবে পালন করা উচিৎ।
৩) শিল্প দিবসঃ ১২ এপ্রিলঃ আমরা খানিক পরে বিজ্ঞানের আরেক মগ্ন উপাসকের ব্যাপারে আলোচনা করব, কিন্তু বাংলায় যিনি প্রথম রসায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষনা করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন ও তারপর সাহসের সঙ্গে এক রাসায়নিক কোম্পানি খুলেছিলেন, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বলেছিলেন ‘science can afford to wait but Swaraj cannot’, সেই জাতীয়তাবাদী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (২ অগস্ট ১৮৬১ – ১৬ জুন ১৯৪৪) ছিলেন প্রকৃত অর্থে প্রথম বাঙালি উদ্যোগপতি, যিনি নিজের স্বল্প সঞ্চয় নিয়ে ১২ এপ্রিল ১৯০১ সালে তৈরি করেছিলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’। অনুরোধ, তার শিল্পোদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১২ এপ্রিল দিনটা বাংলায় শিল্প দিবস বা উদ্যোগ দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হোক।
৪) কবিতা দিবসঃ ২৪ মেঃ বাংলার যে কবি মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যচর্চায় অসংখ্য কবিতা ও গান রেখে গেছেন, যার স্বদেশী গানের সুরে ইংরেজবিরোধী ঢেউ উঠত অবিভক্ত ভারতে, যাকে আজো আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবেই জানি, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ অগস্ট ১৯৭৬)। তার লেখা নজরুলগীতির সংখ্যা প্রায় ৩০০০, যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকেও বেশি। বাংলার বেশিরভাগ বাঙালিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ওনার কোন গানের কথা প্রথমেই মনে আসে, তাহলে অবশ্যই দেশাত্মবোধক, এবং তারপর শ্যামাসঙ্গীত। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ (যা নিয়ে এত বিতর্ক) শুনে বাঙালি হিসেবে যেমন রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ শুনে আমরা যেমন উদ্বেলিত হই, তেমনি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এল খুশির ঈদ’ এইরকম ইসলামি সঙ্গীতও তার হাতে যেন পাখির মত ডাকে। রবিঠাকুরের পর যদি কেউ বাংলা কবিতার সমার্থক হন, তিনি নজরুল। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাংলার নিজস্ব কবিতা দিবস না রাখা খুব অন্যায়। UNESCO যেমন প্রতি বছর ২১ মার্চ ‘ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি ডে’ পালন করে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখনো অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ‘পোয়েট্রি ডে’ পালন করা হয়। একটু অন্যভাবে যদি দেখি, আমরা সাঁওতালি ভাষার লেখক পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু-র জন্য যদি ছুটি দিতে পারি, তাহলে নজরুলের জন্য ২৪শে মে কবিতা দিবস ঘোষনা করা যায় না?
৫) সাহিত্য দিবসঃ ২৬ জুনঃ যে বাঙালির লেখা ১৫টা উপন্যাস বাংলা গদ্য ও ভাষার বিকাশে ‘বঙ্কিমী শৈলির’ জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে রয়ে গেছে, যিনি বাংলার একদম শুরুর দিকের পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, যিনি জীবিকাসূত্রে ব্রিটিশরাজের কর্মকর্তা হলেও আনন্দমঠ উপন্যাসের ‘বন্দে মাতরম্’ ১৯৩৭ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় স্তোত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তিনি আমাদের সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৬ জুন ১৮৩৮ – ৮ এপ্রিল ১৮৯৪)। যদিও সাহিত্যেরই একটা অংশ কবিতা, আমি তবুও বলব, সাহিত্য সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্মদিনে ২৪ জুন আমাদের সাহিত্য দিবস পালন করা উচিৎ। এর কারন বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫০-এর ২৪ জানুয়ারি। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম সংবিধান সভার শেষ অধিবেশন। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ জানালেন, রবীন্দ্রনাথের ‘জনগনমন’ হবে জাতীয় সঙ্গীত। আর সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে চলে আসা ‘বন্দে মাতরম্’ পাবে সমান মর্যাদা, সেটি হবে জাতীয় গান। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির আদেশবলে সেদিন আর কোন ভোটাভুটি হয় নি, বঙ্কিম-ও নিঃশব্দে রবিঠাকুরের সাথে সমান মর্যাদায় ঢুকে গেছিলেন ভারতীয় সংবিধানে। এই মানুষটার সৃষ্টির প্রতি কুর্নিশ জানিয়ে সাহিত্য দিবস পালন করা উচিৎ।
৬) চিত্রকলা দিবসঃ ৭ অগস্টঃ বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ অগস্ট ১৮৭১ – ৫ ডিসেম্বর ১৯৫১) –কে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জনক বলা হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য রেনেসাঁ থেকে স্বতন্ত্রভাবে দূরে উনি থেকে প্রাচ্য রীতিতে চিত্রকলায় স্বদেশী মূল্যবোধ ঢুকিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে বহু ভারতীয় চিত্রকর অনুসরন করেছেন। উনি পছন্দ করতেন মূলত মুঘল ও রাজপুত ঘরানার চিত্রকলা, যার আধুনিকতা ঘটেছিল ওনার হাতে। পরবর্তীকালে উনি চিন ও জাপানের স্টাইল অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে লন্ডনের বিখ্যাত চিত্রকর উইলিয়াম রোদেনস্টাইন ছিলেন অবন ঠাকুরের কাছের বন্ধু। অবন ঠাকুরের ডাকে রোদেনস্টাইন ১৯১০ সালে ভারতে এসেছিলেন, বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট এর বৈশিষ্ট্যগুলো ভালভাবে বুঝতে ও প্রয়োজনে তা নিজের কাজে ব্যবহার করতে। এই কাজে উনি প্রায় এক বছর কলকাতায় থেকে যান। সেই সময় রবি ঠাকুর ওনার লন্ডনের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে ওঠেন ও ম্যাকমিলান থেকে গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। যাই হোক, বাংলার চিত্রকলা বললেই অবন ঠাকুর, তারপর একে একে সবাই। সেই অবন ঠাকুরের স্মৃতিতে ৭ অগস্ট চিত্রকলা দিবস পালিত হোক।
৭) শিক্ষক দিবসঃ ২৬ সেপ্টেম্বরঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১) ছিলেন সেই মানুষ যাকে নবজাগরনের কান্ডারী এবং বিধবা বিবাহের প্রবর্তক ছাড়াও বলা যায় উনি ছিলেন তাঁর পরবর্তীকালের প্রত্যেকের প্রথম শিক্ষক। কারন তার লেখা বর্ণপরিচয় পড়েনি, এমন কোন বাঙালি নেই। প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষে ‘টিচার্স ডে’ পালিত হয়, প্রতি বছর ১১ নভেম্বর ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষে ‘ন্যাশনাল এডুকেশন ডে’ পালিত হয়। তাহলে বাঙালিদের সবার প্রথম শিক্ষক, যিনি আমাদের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ শিখিয়েছিলেন, তার জন্মদিন আমাদের বাঙালিদের জন্য কেন শিক্ষক দিবস হিসেবে রাখা যায় না?
৮) সঙ্গীত দিবসঃ ১৪ অক্টোবরঃ বাংলার নিজস্ব গান বললেই প্রথমে মনে পড়ে বাউল সঙ্গীতের কথা, সহজ ভাবের আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত, যার শেকড় প্রায় ১০০০ বছরের। আর বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকগানের সেই সূত্র ধরে স্বয়ং রবিঠাকুর যার কথা তার নোবেল লেকচারে উল্লেখ করেছিলেন, তিনি লালন ফকির (১৪ অক্টোবর ১৭৭২ – ১৭ অক্টোবর ১৮৯০)। যদিও রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের শাক্তপদাবলী বাংলায় আঠেরো শতকে শ্যামাবন্দনার মাধ্যমে সহজ ভাবের সঙ্গীত প্রচলন করেছিল, কিন্তু লোকগীতির মাধ্যমে আপামর জনমানসে প্রথম ছাপ ফেলেছিল বাউল গান। সেটাও উঠে এসেছিল আঠেরো শতকে। বাউলদের মধ্যে লালন ফকির বা লালন সাঁই সবথেকে জনপ্রিয়। তার গান গ্রামবাংলায় আজো সবার মুখে মুখে। আশ্চর্যের বিষয়, লালন সাঁই হিন্দু না মুসলিম না বৈষ্ণব, আজো কেউ জানে না। তার গানও সেই মন্ত্রেই দীক্ষিত – ‘লালন বলে জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নজরে’। অনুরোধ, লালনের জন্মদিন ১৪ অক্টোবর বাংলায় সঙ্গীত দিবস বা লোকগীতি দিবস হিসেবে পালন করা হোক।
৯) বিজ্ঞান দিবসঃ ৩০ নভেম্বরঃ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ – ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭) ছিলেন সেই বিজ্ঞানী যিনি নিজের জীবদ্দশায় প্রচুর আবিষ্কার করে গেছেন, বেতার তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মাইক্রোওয়েভ সনাক্তকারী সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্র হয়ে গাছের সূক্ষ্ম বৃদ্ধিমাপক ক্রেসকোগ্রাফ অব্ধি। নভেম্বর ১৮৯৫ সালে কলকাতার টাউন হলে দেখিয়েছিলেন বেতার তরঙ্গের জাদু। উনি ছিলেন সেই আচার্য যিনি আমাদের বিজ্ঞানসাধনাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নত করেছিলেন, সামান্য কিছু উপাদান দিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কার আমাদের সামনে রেখে গেছিলেন, যার লেখনীর গুনমুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং রবিঠাকুর। ভারতবর্ষে আমরা ২৮ ফেব্রুয়ারী স্যর সি ভি রমনের ‘রমন এফেক্টের’ আবিষ্কার স্মরনীয় করে রাখার জন্য যদি ‘ন্যাশনাল সায়েন্স ডে’ পালন করতে পারি, তাহলে আচার্য বসুর জন্মদিনে, ৩০ নভেম্বর, আমাদের উচিৎ বিজ্ঞান দিবস পালন করা।
১০) নবজাগরণ দিবসঃ ৪ ডিসেম্বরঃ বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতবর্ষে যিনি প্রথমবারের জন্য স্ত্রী জাতির প্রাপ্য অধিকার দেবার কথা ভেবেছিলেন, তিনি রাজা রামমোহন রায় (২২ মে ১৭৭২ – ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩)। তার আজীবন অক্লান্ত চেষ্টায় ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জঘন্য সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছিল। সেই প্রথা, যেখানে সম্পত্তির লোভে কোন স্বামী মারা গেলে তার বিধবাদেরও আগুনে জলজ্যান্ত ছুঁড়ে ফেলে পুড়িয়ে মারা হত। সেই মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথা যা মহিলাদের শুধুমাত্র পণ্য হিসেবে এবং ক্রীতদাসী হিসেবে দেখত, এবং মহিলাদের আগুনে পুড়িয়ে খুন করার জন্য কোন শাস্তি হত না। ভাবুন, তখনো শ্রীরামকৃষ্ণ, বঙ্কিম, জগদীশচন্দ্র, রবিঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র, কেউ জন্মান নি – সেই সময়ে এই মানুষটির আজীবন লড়াই সমাজের মহিলাদের জন্য সেই যুগান্তকারী অধিকার ছিনিয়ে এনেছিল। আমাদের ছুটির লিস্টে যেমন পঞ্চানন বর্মা ও বিরসা মুন্ডা গুরুত্ব পান, যারা তাদের অঞ্চলের মানুষের জন্য লড়েছিলেন, আমার মনে হয়, রাজা রামমোহন রায়ের জন্য একটা দিন ঘোষনা হওয়া উচিৎ। এবং সেই দিন হওয়া উচিৎ ৪ ডিসেম্বর, যে দিনটা বাংলার ইতিহাসে নবজাগরণ দিবস হিসেবে ঘোষনা হোক।
এবং আমার শেষ প্রস্তাব -
১১) পৌষ সংক্রান্তিঃ এই একটা দিন, আমার মনে হয়, বাংলা ও বাঙালি আবেগকে সামনে রেখে ছুটি ঘোষনা করা উচিৎ। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসব থেকে শুরু করে কালীপুজো, ভাইফোঁটা, সরস্বতী পুজো, শিবরাত্রি, দোলযাত্রা, রথযাত্রা, ইদুজ্জোহা, রাখিবন্ধন – সবেতেই ছুটি, এমনকি বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে জামাই ষষ্ঠীতেও হাফ ছুটি - তাহলে পৌষ সংক্রান্তি কেন নয়? যেখানে বাংলায় অন্যান্য প্রদেশ বা অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি গুড ফ্রাইডে, ফতেহা-দোয়াজ-দহম, ছট পুজো, ক্রিসমাস ডে উপলক্ষ্যে ছুটি রাখা হয়, সেখানে পৌষ সংক্রান্তি বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের একদম নিজস্ব লোকসংস্কৃতি। পুরান ঘাঁটলে পাওয়া যায় যে ঋষি বিশ্বামিত্র এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। মহাভারতেও মাঘ উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দিন থেকে আসলে সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হয়। ফলে বাংলার লোক সংস্কৃতিতে সূর্যের পুজো করে রবিশস্য ঘরে তোলার প্রচলন দেখা যায় এই দিনে। কোথাও গঙ্গায় বা অন্য কোন নদীতে ডুব মেরে শুদ্ধ হওয়ার রীতি, কোথাও নতুন কাপড় পরার প্রচলন, কোথাও ‘আউনি বাউনি’, কোথাও ঘুড়ি ওড়ানোর পার্বন, কোথাও আবার বিভিন্ন রকম পিঠে-পুলির উৎসব। বীরভূমের কেঁদুলী গ্রামে এই দিনেই ঐতিহ্যবাহী জয়দেব মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রধান আকর্ষন বাউল গান। সে যেভাবেই হোক, এই দিন বাংলা লোক সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে। ফলে, এই একটা দিন, বাংলায় শীতকালীন উৎসব উপভোগ করার ছুটি থাকা উচিৎ।
বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত আবেদন – আপনি তো বাংলা সংস্কৃতি রক্ষার জন্য অনেক কিছু করেছেন ও করছেন – আমার এই প্রস্তাবগুলো একটু ভেবে দেখবেন। আগত নতুন বছর সবার শুভ হোক।
(লেখক এক অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, কৌরব পত্রিকার ভূতপূর্ব সম্পাদক এবং কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, এবছর ওনার লেখকজীবনের ৩০ বছর পূর্ণ হল)