Chandrayan-3
চন্দ্রায়ন-৩ : চাঁদের মাটিতে ভারতের বিজয়পতাকা
Bengal Times News, 23 August 2023
ড. অভিজিৎ মিত্র
২৩ অগস্ট ২০২৩, সন্ধে ৬ টা ৪ মিনিট। Indian Space Research Organization (ISRO)-র চন্দ্রায়ন-৩ এর বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদ ছুঁল। বলা ভাল, ইতিহাস তৈরি করে পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিন মেরু জয় করল। কারন এর আগে যে তিন দেশ চাঁদে তাদের যান অবতরন করিয়েছে – আমেরিকা, রাশিয়া ও চিন, তারা কেউ চাঁদের দুর্গম দক্ষিন মেরুতে পা রাখতে পারে নি। সত্যি কথা, আজ ভারতবাসী হিসেবে ভীষন গর্ব হচ্ছে। ইসরোকে হ্যাটস্ অফ বলতেই হচ্ছে। কারন চন্দ্রায়ন-৩ এর চাঁদের মাটি ছোঁয়া বেশ দুর্গম কাজ ছিল। বিশেষ করে শেষ প্রায় ৪০ মিনিটে বিক্রম যে ৩০ কিলোমিটার উচ্চতা নেমেছে এবং চাঁদের মাটির খানাখন্দ, পাহাড়, এবড়োখেবড়ো পাথর এড়িয়ে যে সফলভাবে নামতে পেরেছে, সেটা দুরন্ত এক সাফল্য। এবং যাত্রাপথে প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য স্থির রেখে একে একে বাধা টপকে এগিয়ে যাওয়া, সেটাকেও সাধুবাদ জানাতেই হয়। কেন? সেটাই একটু দেখা যাক।
যেহেতু আমি মূলত একজন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনীয়ার, এবং স্যাটেলাইট (কৃত্তিম উপগ্রহ) বা রকেটযান সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানি, তাই একটু প্রকৌশলী কথা বলি। সাধারনত যে কোন রকেটযানে, যা চাঁদ বা অন্য কোন গ্রহের পিঠে নামবে, তিনটে মূল যন্ত্রাংশ থাকে। অরবাইটার, ল্যান্ডার ও রোভার। অরবাইটার হল সেই স্পেসক্রাফট যা পৃথিবীর অভিকর্ষ ছাড়িয়ে তার ভেতরের অংশকে এক নির্দিষ্ট জায়গা অব্ধি পৌঁছে দিয়ে তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, মহাকাশে খসে পড়ে, আর ফেরৎ পাওয়া যায় না। এই অরবাইটার ছেড়ে চলে যাবার পর ভেতরের ল্যান্ডার বেশ খানিকটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের গন্তব্যে নামে। আর গন্তব্যে নামার পর তার পেট থেকে যে ছোট রোবোটিক সৌরচালিত গাড়ি বেরিয়ে এসে সেই পৃষ্ঠতল ঘুরে ঘুরে দেখে, তথ্য সংগ্রহ করে, ছবি বা ভিডিও তোলে, তুলে পৃথিবীতে পাঠায়, তার নাম রোভার।
কিন্তু যত সহজে এগুলো বললাম, এর কোনোটাই তত সহজে হয় না। এই যে চন্দ্রায়ন–৩ সেই ১৪ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল, আর আজ ২৩ অগস্ট চাঁদে নামল, ভাবুন তো, এই ৪১ দিন মহাকাশে কি কি সমস্যা কাটিয়ে যেতে হয়েছে। একটু গভীরে গেলে বুঝবেন কাজটা কত কঠিন ছিল। ৩৯০০ কেজি ওজনের একটা LMV3 অরবাইটার পৃথিবীর টান কাটিয়ে ওপরে ওঠাটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। মনে রাখবেন, রকেট যে কোন যায়গা থেকে ছাড়া যায়না। ভারতে একমাত্র শ্রীহরিকোটা থেকে ছাড়তে হয়, সঠিক সময়ে ছাড়তে হয়। এই জায়গা বিষুবরেখার ওপর অবস্থিত বলে রকেট ছাড়ার পর পৃথিবীর দিকে অভিকর্ষ টান একটু বেশি পাওয়া যায়, যাতে রকেট কোনভাবেই পৃথিবী ছাড়িয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যেতে না পারে। আবার লঞ্চপ্যাড থেকে ছেড়ে কোন রকেটকেই সোজা পৃথিবী ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয় না, তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রন করা যায় না। তাকে উপবৃত্তাকারে পৃথিবীকে ঘুরতে হয়, ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে হয়, তারপর একসময় এক নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে, পৃথিবীর টান যখন নগন্য, চাঁদের দিকে যাত্রা শুরু করতে হয়। একে ‘লুনার ট্রান্সফার ট্র্যাজেক্টরি’ বলে। গণনায় একটু এদিক ওদিক হলেই – ফুস! সোজা মহাকাশে হারিয়ে যাবে সেই রকেট। তারপর একইভাবে চাঁদের কক্ষপথে নেমেও উপবৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে দূরত্ব কমাতে হয়। অবশেষে ৩০-৩৫ কিলোমিটার নামতে হয়। চন্দ্রায়ন-৩ যেমন শেষ ৩০ কিলোমিটার নেমেছে। এবং নামার শেষ মুহুর্তে জ্বালানীর থ্রাস্টার দিয়ে চাঁদের দিকে ধাক্কা মারতে হয়, গতি একদম কমিয়ে আনতে হয়, একে সফট্ ল্যান্ডিং বলে, যাতে সেই যান চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে টুকরো বিটুকরো না হয়ে যায়। আরো অনেক গভীর কৌশল লুকিয়ে আছে, কিন্তু আপাতত এটুকু জানলেই আমাদের চলবে।
তো, একটু মনে করে দেখুন, এর আগে চন্দ্রায়ন–২ যখন ২২ জুলাই ২০১৯ যাত্রা শুরু করেছিল আর ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ চাঁদের বুকে আছড়ে পড়েছিল, পাক্কা ৪৭ দিন পর, তখন আমরা সবাই খুব আঘাত পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমরা হয়ত পারব না। খুব শক্ত। ঐ যে একটু আগে লিখলাম, ভেতরের কলকব্জা গুলো, প্রকৌশল গুলো, খানিক জানি বলেই বলছি, ভীষন শক্ত কাজ। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে চন্দ্রায়ন – ৩ করে দেখাল তো! দেখিয়ে দিল, আমরাও পারি, আমরাও অন্য দেশের তুলনায় কম নই।
এরপর বিক্রমের পেট থেকে বেরিয়ে আসবে রোভার প্রজ্ঞান। কাজ করবে সৌরশক্তিতে। আগামী ১৪ দিন চাঁদের দক্ষিন মেরু ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করবে ও ইসরোকে পাঠাবে। এই ১৪ দিন খুব গুরুত্বপূর্ন। কারন আমাদের ১৪ দিন = চাঁদের মেরুর এক বেলা। ফলে ১৪ দিন পর চাঁদের দক্ষিনমেরুতে সূর্য ডুবে যাবে। তার আগেই সমস্ত তথ্য তুলে নিতে হবে। আমরাও অপেক্ষায় থাকব প্রজ্ঞান কি কি তথ্য পাঠায় তা দেখার, বোঝার জন্য।
এই প্রসঙ্গে, আজ এই ভীষন খুশির দিনে, একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০০৮ সাল। আমি তখন আইআইটি গুয়াহাটির শিক্ষক। সেই সময় ইসরো-র সঙ্গে প্রায় দু’বছর এক গবেষনাধর্মী কাজ করেছিলাম। ওদের Space Application Centre (SAC)-এ গিয়ে প্রায় ১৫ দিন কাটিয়েছিলাম। এই যে ল্যান্ডার বিক্রমের ছবি আজকাল আমরা সবাই দেখছি, সেই রকম আরেক ল্যান্ডার ওদের ওখানে গিয়ে প্রথম চোখের সামনে দেখেছিলাম। কোভিড পিরিওডে যে রকম পিপিই কিট পরে স্যানিটাইজেশন করে বিভিন্ন যায়গায় যেতে হত, সেই ২০০৮ সালে ওদের ল্যান্ডারের ঘরে ঢোকার জন্য খানিক সেইরকম করতে হয়েছিল। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ইসরোকে যোগাযোগ ব্যবস্থার এক ছোট্ট কৌশল দিয়েছিলাম – ডবল BOC মডিউলেশন। সেটা স্যাটেলাইটের নেভিগেশনে এত ভাল কাজ করেছিল যে ওখানকার অধিকর্তা বলেছিলেন, পরের স্পেস মিশন থেকে আমার সেই ছোট্ট টেকনিক ওনারা ব্যবহার করবেন। জানিনা, ওরা সেটা আজও ব্যবহার কেন কিনা, কিন্তু আজ, ১৫ বছর আগে ইসরোর সঙ্গে কিছুদিন জুড়ে থাকার জন্য, ভীষন আনন্দ হচ্ছে, ভীষন গর্ব হচ্ছে। এটা আমি ভাষায় ঠিক প্রকাশ করে বোঝাতে পারব না।
(লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং আইআইটি গুয়াহাটির ভূতপূর্ব অধ্যাপক)