SHRIMAD BHAGAVAD GITA AND GITA JAYANTI
"শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও গীতা জয়ন্তী"
🔘 ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায়
▶️ গীতা সংস্কৃতে রচিত ১৮ অধ্যায়ের ৭০০ শ্লোকের বই৷ তাই একে সপ্তশতী বলে। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৩-৪০ নম্বর অধ্যায়ের অন্তর্গত। পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী "শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা"। শ্রীমদ মানে সুন্দর বা সুমিষ্ট। ভগবত অর্থ ভগবানের মুখ নিঃসৃত৷ গীতা মানে গীত বা গান বা বাণী৷ অর্থাৎ শ্রীমদ্ভগবদগীতা মানে ভগবানের সুমিষ্ট বাণী৷ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগে শত্রুপক্ষে গুরু, আত্মীয় ও বন্ধুদের দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এমন নয় বলে মাত্র ৪৫ মিনিটে এই জ্ঞান দিয়েছিলেন। যাতে মানবজীবনের সব প্রশ্নের সহজ উত্তর মেলে। আমরা বেদব্যাসের মহাভারতের অংশ হিসাবে তা পাই। মহাভারত রূপ বিরাট ফলের শাঁস গীতা৷ স্মৃতি শাস্ত্রের অন্তর্গত আসলে গীতা "উপনিষদগুলিরও উপনিষদ"৷ গীতোপনিষদ৷ মোক্ষশাস্ত্র৷ স্বর্গের চেয়ে ভালো মোক্ষ লাভের উপায়৷ আসলে মহাভারতের একটি অংশ৷
মহাভারতের অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম দিন পূর্বাহ্নে স্বয়ং ভগবান সারথী তথা সখা হয়ে অর্জুনকে মাত্র ৪০ মিনিটে গীতা রূপ মহাজ্ঞান শুনিয়েছিলেন৷ উদ্দেশ্য সমগ্র মানব জাতিকে কর্মযোগে উৎসাহিত করা৷ গীতার ১৮টি নাম৷ গঙ্গা, গীতা, সাবিত্রী, সীতা, সত্যা, পতিব্রতা, ব্রহ্মাবলী, ব্রহ্মবিদ্যা, ত্রিসন্ধ্যা, মুক্তিগেহিনী, অর্ধমাত্রা, চিতানন্দা, ভবগ্নী, ভ্রান্তিনাশিনী, বেদত্রয়ী, পরানন্দা, তত্ত্বার্থ, জ্ঞানমঞ্জুরী। ২০২২- এ গীতা জয়ন্তী পালিত হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর। সেবার ছিল শ্রীমদ্ভবদগীতার ৫১৫৯ -তম বার্ষিকী৷ খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩৮ অব্দে কুরুক্ষেত্রে ১৮ দিন ধরে যুদ্ধ হয়েছিল৷ গীতা জয়ন্তীর দিন আমরা মন শান্ত রেখে খারাপ চিন্তা মুক্ত হয়ে ফুল, চাল, দীপ, ধূপ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও গীতার পুজো করে গীতা পাঠ করি৷ ওইদিন গীতা দান করা হয়৷ অনেকে হোম -যজ্ঞও করেন৷ এবছর সারা বিশ্ব জুড়ে ডিসেম্বর মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে গীতা জয়ন্তী মহোৎসব হয়৷ গতবার মায়াপুরের ইসকন মন্দিরে গীতা জয়ন্তী নাম যজ্ঞ মহোৎসবে বাংলার হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়ের সাধু, সন্ন্যাসী, পন্ডিত, মাতাজী, ধর্মগুরু ও শিক্ষার্থীরা একযোগে গীতা পাঠ করেছেন৷ পাঁচ হাজার লোকের এই গীতা পাঠ গিনেস বুকে নাম তোলে। হয়েছিল আহূতি, হোম, যজ্ঞ, পূজা ও কীর্তন৷ ২০২৩- এ ২২ ডিসেম্বর শুক্রবার হয়েছিল গীতা জয়ন্তী মহোৎসব৷ ২০২৪- এ ১১ ডিসেম্বর বুধবার গীতা জয়ন্তী পালিত হয়। মন্দিরে মন্দিরে গীতা পাঠের মাধ্যমে৷ এদিন থেকে ৫১৬২ -বছর আগে বাংলার ২১ অগ্রহায়ণ মাসের মোক্ষদা একাদশী তিথিতে মঙ্গলবারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়৷ বাংলা সনের ৩০/৩১ দিন ধরলে তা ২০/ ২১/২২ কার্তিক হতে পারে৷ ওইদিন সকালে গীতার আবির্ভাবের সময় বলে ডি এস দ্বিবেদী অনেক গবেষণা করে জানিয়েছেন। আবার সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ১৩০১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কলিযুগের শুরু৷ তিনি বলেছেন ৩১৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে বসেন৷ তার ১১১৫ বছর আগে মানে ১৪৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ৩৬ বছর রাজত্বের পর যুধিষ্ঠির সিংহাসন ত্যাগ করেন৷ সে অনুযায়ী ১৪৬৬ খ্রিঃপূঃ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সাল৷ যাইহোক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রথম দিনের স্মরণে আমরা পালন করি " গীতা জয়ন্তী" উৎসব৷ সেদিনটি অবশ্য এখন পালিত হয় মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ মাস বা ইংরেজি ডিসেম্বর মাসের শুক্লপক্ষের মোক্ষদা একাদশী তিথিতে। এত বছরে গ্রহ নক্ষত্রের তফাৎ হওয়ায় তখনকার ঐ তিথি এই সময়ে দাঁড়িয়েছে৷ অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্রে আত্মীয় পরিজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে ইতস্তত করছিলেন তখন ভগবান সত্য, কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান ও ভক্তির দর্শন প্রিয় ভক্ত অর্জুনকে প্রদান করেছিলেন৷ অর্জুন ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত এই বাণী শুনেছিলেন বেদব্যাসের কাছে দিব্যদৃষ্টি লাভ করায় সঞ্জয়, অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে হনুমান এবং ঘটোৎকচের ছেলে বর্বরিক। ভগবান যখন বিশ্বরূপ দেখান কাল থেমে যায়৷ গীতাকে আমরা বলি গীতোপনিষদ ও সর্ব শাস্ত্রের সারতিসার৷ এই গ্রন্থ পড়ে আমরা ঈশ্বর বা ভগবান, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম বিষয়ে জানতে পারি৷ আমার লেখা "সনাতনী কৃষ্টিকথা" এবং "হিন্দু ধর্ম " বইদুটিতে গীতা, ভাগবত, পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ, বেদ, উপনিষদ, দেবদেবী, পূজা পার্বণ সহ এমন নানা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন৷ আমার ৯৭৩২২১৭৪৮৯ নম্বরে যোগাযোগ করে তিনশো টাকা বই প্রতি মোট ৬০০টাকা ফোন পে বা গুগুল পে করে ক্যুরিয়ারে নিজের বাড়ীতে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন৷ গীতা হলো মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫ থেকে ৪২ তম বা ১৮ টি অধ্যায়৷ গীতার ২য় অধ্যায়কে বলে গীতার সারাংশ৷ মাত্র ৪টি শ্লোকে ১০ অধ্যায়ের ৮ থেকে ১১ নম্বর শ্লোকে রয়েছে সারমর্ম। গীতায় অর্জুন ১৬ টি প্রশ্ন করেন আর শ্রীকৃষ্ণ তা ৫৭৪ টি শ্লোকের মাধ্যমে উত্তর দেন৷ এছাড়া সঞ্জয় ৪০টি এবং ধৃতরাষ্ট্র ১টি শ্লোক বলেছিলেন ৷ পুরো গীতায় ৯৫৮০ টি সংস্কৃত শব্দ পাই৷ গীতার মোট শ্লোকের ৬৪৫টি অনুষ্টুপ এবং ৫৫টি ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত৷ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের ৪৩টি এবং অর্জুনের ২২টি নাম উল্লেখিত আছে৷ বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এই গ্রন্থ সমসাময়িক বিষয়গুলির মোকাবিলা করে মানবতার দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করে চলেছে৷ এতে আমরা ভগবান, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম জানতে পারি৷ গীতায় সাধুর ২৬ টি গুণ এবং ৬ টি আসুরিক প্রবৃত্তির কথা বলা হয়েছে৷ তেমনি বলা হয়েছে ভক্তের ৩৬টি গুণের বর্ণনা৷ গীতায় কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণের ৯টি , ক্ষত্রিয়ের ৭টি , বৈশ্যের ৩টি , শুদ্রের ১টি এবং নারীর ৭টি বিশেষ গুণ বর্ণিত আছে ৷ গীতায় আছে ব্রহ্ম উপলব্ধির ৫টি স্তরের আলোচনা৷ গীতায় বর্ণিত ২৫জন সৃষ্ট হলেন, কৃষ্ণ > ব্রহ্মা > চতুষ্কুমার > সপ্ত মহর্ষি > চতুর্দশ মনু৷ নরক আসলে মানুষের কাম, ক্রোধ ও লোভ৷ যা পাঠ, শ্রবণ, দর্শন কিংবা স্পর্শে পাওয়া যায় অপার স্বর্গীয় সুখ৷ গীতাকে বারবার বললে উচ্চারিত হয় ত্যাগ৷ যা গীতার মূলমন্ত্র৷ গীতার ১৮টি অধ্যায়ের প্রথম ৬টি কর্মষটক, মাঝের ৬টি ভক্তিষটক এবং শেষ ৬টি অধ্যায়কে জ্ঞানষটক বলা হয়৷ প্রায় ২০০ টি ভাষায় অনুবাদ হয়ে শুধু হিন্দু বা ভারতীয়দের মধ্যে নয় বিশ্বজনীন হয়ে গেছে। আবার অনেক ভাষায় বহু ব্যক্তি এর অনুবাদ করেছেন৷ ইংরেজিতে - ৮৮ , বাংলায় - ৫২, জার্মান ভাষায় - ১২, স্পেনে - ১৩ জন সহ অসংখ্য গীতাজ্ঞানী এই মহাগ্রন্থের অনুবাদ করেছেন৷ আশ্বর্যের বিষয়, প্রায় সব অনুবাদক সনাতন ধর্মকে পরে আপন করে নিয়েছেন৷ গীতায় আছে - অর্জুন বিষাদ যোগ, সাংখ্য যোগ, কর্ম যোগ, জ্ঞান যোগ, সন্ন্যাস যোগ, ধ্যান যোগ, জ্ঞান বিজ্ঞান যোগ, অক্ষরব্রহ্ম যোগ, রাজবিদ্যা - রাজগুহ্য যোগ, বিভূতি যোগ, বিশ্বরূপ দর্শন যোগ, ভক্তি যোগ, গুণত্রয় বিভাগ যোগ, পুরুষোত্তম যোগ, দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ যোগ, শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ এবং মোক্ষ যোগ৷ গীতা পড়লে ত্রিতাপ দুঃখেও মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখেও তাঁর স্পৃহা থাকে না আর তিনি হন রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনি হন স্থিতধী বা স্থিতপ্রজ্ঞ৷ ( দুঃখেষু, অনুদ্বিগ্নমনাঃ, সুখেষী, বিগতস্পৃহ, বীত -রাগ-ভয় - ক্রোধ, স্থিতধীঃ, মুনিঃ, উচ্যতে ৷৷ গীতা - ২/৫৬)৷
এলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন ," আমি যখন গীতা পড়ি এবং ভগবানের এই বিশ্ব সৃষ্টির বিষয় নিয়ে চিন্তা করি তখন অন্য সব কিছুই তার কাছে নিতান্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়"৷ তিনি আরো বলেছেন ," I try humbly to comprehend asinflnitestimal part of the intelligence , menifest in nature.
হামবোল্ট বলেছেন ," I have offered thanks to GOD that I have been allowed to live long enough to read the Bhagavad Gita. টি.এস. ইলিয়ট বলেছেন , "পৃথিবীতে যে দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ গীতি কাব্য ( Lyric) আছে, তার একটি গীতা৷ জার্মান কবি হারমান হেসি বলেছেন জীবন ও জ্ঞানের এমন সুন্দর উদঘাটন ধর্ম ও দর্শনের প্রকৃত রূপ তুলে ধরে৷ থিওসোফিস্ট এনি বেসান্ট বলেছেন গীতা তাঁকে জীবন পাঠ শিখিয়েছে৷ তাই তিনি " দি লর্ডস সং" নামে গীতার সুন্দর ইংরেজি অনুবাদ করেন। ভগবদগীতার নিষ্কাম সেবা ছিল মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণা৷ আমেরিকান বিজ্ঞানী ১৯৪৫ বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা দেখার পর বলেছিলেন "এখন আমি বিশ্ববিধ্বংসী মৃত্যু হয়েছি " ( গীতার ১১ অধ্যায়ের ৩২ সংখ্যক শ্লোকে আছে )৷
আর জগৎগুরু আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন ," From a clear knowledge of BHAGAVAD GITA all the goals of human existence become fulfilled . Bhagavad Gita is the manifest quintessence of all the teachings of the Vedic scriptures"! আসলেই নানা প্রবচন শুনে ও গীতা পড়ে আমার মনে হয়েছে , গীতা পড়া উচিত আমাদের মত অজ্ঞদের জ্ঞানের জন্য৷ শিক্ষিতদের নম্র হওয়ার জন্য, গরীবদের সান্ত্বনার জন্য, ধনীদের অনুকম্পার জন্য, বাস্তববাদীদের পরামর্শের জন্য আর যাঁরা স্বপ্নালু তাঁদের মুগ্ধতার জন্য৷ যা বৃদ্ধদের দেয় মৃত্যুর কৌশল শেখার উপায়৷ আর, যুবকদের দেয় বাঁচার কৌশল শেখার হদিশ৷ গীতা ও সমুদ্র দুইই গভীর৷ কিন্তু, সাগরের গভীরে মানুষ তলিয়ে যায়৷ অন্যদিকে গীতার গভীরতায় মানুষ উদ্ধার লাভ করে৷ জয়তু গীতা৷ জয় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ৷ সবাইকে জানাই গীতা জয়ন্তীর অভিনন্দন ৷