knee pain
"হাঁটুর ব্যথা "
🔵 ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায়
▶️ হাঁটু বা Knee হলো শরীরের বৃহত্তম অস্থি সন্ধি বা জয়েন্ট ৷ পায়ের উপরের হাড় ফিমার ও নিচের বড় হাড় টিবিয়ার জয়েন্ট। মাঝে থাকে প্যাটেলা বা মালাই চাকি নামের মেলিস্কাস হাড়৷ পুরো জয়েন্টটা সাইনোভিয়াল মেমব্রেন বা ঝিল্লি দিয়ে ঢাকা থাকে৷ যা সাইনোভিয়াল ফ্লুইড তৈরী করে৷ যেমন মোটরের ইঞ্জিন অয়েল ঘর্ষণ জনিত ক্ষয় রোধ করে৷ এটা শরীরের সবচেয়ে জটিল সাইনোভিয়াল জয়েন্ট৷ হাঁটুর জয়েন্টের জন্য আমরা হাঁটতে, দৌড়াতে ও নাচতে পারি৷ মিডিয়াল টিবিও -ফেমোরাল, ল্যাটারাল টিবিও -ফেমোরাল এবং প্যাটেলো -ফেমোরাল জয়েন্ট নিয়ে তৈরী৷ থাকে কোয়াড্রিসেপস সহ কয়েকটি টেন্ডন, এন্টিরিয়ার, পোস্টেরিয়ার, মিডিয়াল ও ল্যাটারাল ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ও তরল পূর্ণ স্থান বারসা৷ থাকে সূক্ষ্ম নার্ভ জালিকা৷ যা ব্যথার অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়৷
কখনো না কখনো হাঁটুর ব্যথায় ভোগেনি এমন মানুষ বিরল। বয়স্কদের সাধারণ সমস্যা৷ হাঁটুর ব্যথা অবস্থান ও কষ্ট দেখে আমরা চিকিৎসকরা রোগ চিহ্নিত করি৷
১| মেনিসকাল টিয়ার - Menisci হাঁটুতে ফিমার ও টিবিয়ির মধ্যে ধাক্কা প্রতিরোধ করে। কিন্তু, জোরে দুমড়ে, মুচড়ে বা ঘুরে গেলে মেনিস্কাস ছিঁড়ে গিয়ে এমনটা হয়৷ এই রোগে জয়েন্ট লক হয়ে যায়৷
২| লিগামেন্ট টিয়ার বা মচ - ক্রস আকৃতির ক্রুসিয়েট লিগামেন্টগুলি হাঁটুকে স্থিতিশীল করে৷ দৌড় -ঝাঁপ ও খেলতে গিয়ে ACL বা এন্টিরিয়ার ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট কখনো PCL পোস্টেরিয়ার ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট আঘাত প্রাপ্ত হলে এমনটা হয়৷
৩| প্যাটেলোফেমোরাল পেন সিনড্রোম - ম্যালালাইনমেন্ট, পেশীর ভারসাম্যহীনতা, কন্ড্রোম্যালাসিয়া প্যাটেলার জন্য খেলোয়াড় সহ অনেকের হাঁটুর ক্যাপের চারপাশের ব্যথাকে ডাক্তারী ভাষায় এমনটা বলা হয়৷
৪| অস্টিও আর্থারাইটিস - সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ হাঁটু জয়েন্টে ঘষা লেগে বা আর্টিকুলার কার্টিলেজের ক্ষয়ের OA হয়৷ এতে জয়েন্টের কার্টিলেজ বা তরুণাস্থির ক্ষয় হয় ৷ এক্স রে তে হাড়ের ছবি এলেও কার্টিলেজের ছবি দেখা যায় না ৷ ঘুম থেকে ওঠার পর OA র ব্যথা বেশি হয় ৷ ২০ বছরের পর থেকে মানব শরীরে এক শতাংশ হারে কোলাজেন কমতে থাকে৷ শাক সবজি, হাড়ের ঝোল ইত্যাদি এর ভালো উৎস৷ ওমেগা -৩ ফ্যাটি এ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, ক্যালসিয়াম আছে এমন খাদ্য খেতে হবে। ৫০ বছরের পর থেকে প্রায় অর্ধেক মানুষ এই রোগে ভোগেন। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরো বেশি হয়৷
৫| অন্যরকম আর্থারাইটিস - প্রদাহ ও সংক্রমণের জন্য অটো ইমিউনডিসঅর্ডার রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, সংক্রমণের জন্য সেপটিক আর্থারাইটিস, পোস্ট ভাইরাল আর্থারাইটিস, এনকালাইজিং স্পন্ডিলাইটিস। জয়েন্টে বিপাকীয় জিনিস জমে গাউট ইত্যাদি কারণে হয়৷
৬| হাঁটুর বারসাইটিস - পপলিটাল ফসা সহ হাঁটুর জয়েন্ট এলাকায় হতে পারে৷
৭| ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড সিনড্রোম - এটা একটি পুরু তন্তুযুক্ত ব্যান্ড যা নিতম্বের জয়েন্টের বাইরে থেকে উথ্থিত হয়ে হাঁটু জয়েন্টের বাইরে শেষ হয়৷ সাইক্লিস্ট , ম্যারাথন দৌড়বীররা ব্যান্ডটি শক্ত হয়ে হয়। ব্যথা সংবেদনশীল সাবক্রোমিয়াল সাবডেলটয়েড বার্সায় আঘাত, ক্ষয়, সিস্টেমিক অসুস্থতাতে থেকে হতে পারে৷ জীবন ধারার পরিবর্তন, ইলেক্টোথেরাপি ও ওষুধ কাজে আসে৷
৮| মিডিয়াল টিবিয়াল স্ট্রেস সিনড্রোম - শিন স্প্লিন্ট হয়ে টিবিয়ার সংযোগ স্থলে ব্যথা - যন্ত্রণা হয় ৷
শুয়ে থেকে বা বসার পর উঠতে গেলে, সিঁড়ি ভাঙতে হাঁটুর ব্যথায় কাবু রোগীরা আমাদের কাছে আসেন৷ উপরের অনেক কারণ থাকলেও বেশি হয় রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস ও অস্টিও আর্থাইটিস বা বয়স জনিত অস্থিসন্ধি ক্ষয়৷ দুর্ঘটনার জন্য হাঁটুর ব্যথা হয়৷ কিছু টিউমারের জন্য হাঁটুর ব্যথা হতে পারে৷ ব্যথার জন্য হাঁটুর চারপাশ লাল হলে ত্বক গরম হলে বুঝতে হবে ইনফেকশন হয়েছে৷ জয়েন্টের সাইনোভিয়াল ফ্লুইড ভাসতে পারে৷ এতে ব্যথা ও ফোলা বাড়ে৷ হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিও পোরোসিস হলেও হাঁটুর ব্যথা হয়৷ দীর্ঘক্ষণ হাঁটু মুড়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ ধরে একভাবে কাজ করলে, মোটা চেহারা হলে, শরীরচর্চা না করলে শরীরের এই কব্জা খারাপ হয়৷ মাসিক বন্ধের পর মহিলাদের হাড়ে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়ায় চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের বেশি হয়৷ মহিলাদের হাঁটু তুলনায় ছোট হওয়াও একটা কারণ৷ হাঁটু মুড়ে বা ঝুঁকে কাজ করলে বেন্ডিং মোমেন্ট বা চাপ তৈরী হয়ে মালাই চাকি হাড়ের তলার অংশের কার্টিলেজে চাপ দেয়৷ প্রত্যেকের উচিত দিনে আধ ঘন্টা ব্যথার স্থানে সূর্যালোক লাগানো ৷ প্রতি ইঞ্চি হিসাবে এক কিলোগ্রাম এরকম ওজন আদর্শ। নচেৎ কমাতে হবে। গাঁটের ব্যথা থেকে পেশিতে টান ধরা ও স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে৷ পুরুষ ও মহিলা উভয়েই আজকাল বাড়ীর ভিতরে থাকায় সূর্যের আলোর অভাবে ভিটামিন - ডি র অভাবে রোগে ভুগছেন৷ ব্যথার প্রথম ৪৮- ঘন্টা বরফ সেঁক দিতে হবে৷ এরপর গরম জলের বা বরফের সেঁক বা কোল্ড কম্প্রেস, খোলা ক্রেপ ব্যান্ডেজ, হাঁটুর ব্যায়াম যেমন - আইসোমেট্রিক কোয়াড্রিসপস, হামস্টিং স্টেচিং, কোয়াড্রিসেপস স্টেন্থডিং এক্সারসাইজ, ব্যথানাশক ওষুধ সামান্য ডিপ্রেশনের ওষুধ, গ্লুকোসামিন, মালিশ, স্প্রে ইত্যাদি কাজে আসে৷ হোমিও প্যাথি এবং আয়ুর্বেদে হাঁটুর ব্যথার খুব ভালো চিকিৎসা আছে৷ আদা, হলুদ, শুঁট, পিপুল, হরিতকী উপকারী৷ পিপারমেন্ট, ইউক্যালিপটাস ও ল্যাভেন্ডার তেল মালিশ ভালো৷ ইপসম সল্ট জলে দিয়ে হাঁটু চুবিয়ে রাখলে পেশি শিথিল হবে৷ হোমিওপ্যাথিতে ব্রাইওনিয়া, রাস টক্স, আয়োডাম, ল্যাকেসিম, লিডাম পল, আর্ণিকা মন্ট, ফেরাম মেট, সাঙ্গুনেরিয়া ক্যান, রুটা, বেলেডোনা, মেডোরহিনাম, সাইলেশিয়া, কলচিকাম ইত্যাদি লক্ষণ অনুযায়ী দিলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন৷
হাঁটুতে চাপ কমাতে কুশনিং ও সঠিক আর্চ সার্পোট আছে এমন জুতো পড়ুন৷ একটানা বেশিক্ষণ বসা বা দাঁড়ানোর বদলে মাঝেমাঝে বিশ্রাম নিন৷ তবে, নিজেকে সক্রিয় রাখুন। সঠিক ভঙ্গিতে বসুন ও দাঁড়ান৷ ভালো চিকিৎসকের পরামর্শমত চললে খুব খারাপ অবস্থা ছাড়া নিরাময় হয় বা ভালো রাখা যায়৷ ওজন নিয়ন্ত্রণ, মাটিতে বসে কাজ, হাই কমোড ছাড়া পায়খানা করা যাবে না৷ ধূমপান, মদ্যপান, তৈলাক্ত খাবার এড়াতে হবে৷ প্লেটলেট রিচ প্লাজমা ইঞ্জেকশন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নার্ভ ব্লক পদ্ধতি, ভিসকো সাপ্লিমেন্ট ইনজেকশনও কিছু ক্ষেত্রে বেশ কাজ দেয়৷ তা ৬ মাস বা ৬ সপ্তাহ অন্তর দিতে হয়৷ সবশেষ হলো আংশিক বা সম্পূর্ণ হাঁটু প্রতিস্থাপন৷ হাঁটুর ব্যথায় আয়ুর্বেদে যোগরাজ গুগ্গুল, চন্দ্রপ্রভা, বাত গঞ্জাকুশ বড়ি দেওয়া হয়। মহানারায়ণ তৈল মালিশ করতে হয়৷ আকুপাংচারে ব্যথাহীন হ্যামারিং করে টিএনএস প্লেট, সূঁচ ফুটিয়ে মক্সিবাশ্চান করা হয়৷ এমন ৬০টির বেশি রোগ তার বিভিন্ন পদ্ধতির সর্বাধুনিক চিকিৎসা নিয়ে আমার বই "রোগ পরিচয়" লিখেছি। ৩০০ টাকা দামের আমার নতুন বইটির উদ্দেশ্য চিকিৎসকদের নিরন্তর পাঠে সাহায্য করা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিস্তারিত তথ্য দেওয়া এবং শিক্ষিত রোগী তৈরী করা৷ আশাকরি আমার অন্য বইগুলির মত স্বাস্থ্য বিষয়ক এই বইটিও জনপ্রিয় হবে ৷
Pic. Courtesy : Internet
চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ : ৯৭৩২২১৭৪৮৯